রপ্তানিমুখী সব শিল্প খাতের রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা বাবদ সরকারের কাছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই টাকা চাওয়া হয়েছে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর অর্থাৎ প্রথম প্রান্তিকের জন্য। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ১ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে।
দেশীয় বস্ত্র, হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ, চামড়াজাত দ্রব্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্যসহ অনুমোদিত অন্যান্য খাতে রপ্তানির বিপরীতে বিভিন্ন হারে নগদ সহায়তা বা ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। খাত ভেদে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়। আর পোশাক খাতে দেওয়া হচ্ছে রপ্তানির বিপরীতে ১ শতাংশ হারে বিশেষ নগদ সহায়তা। চিঠিতে এসব কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব খাতে সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকি ও বিশেষ নগদ সহায়তা বাবদ চার কিস্তিতে মোট ৬ হাজার ৬৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিজিএ) থেকে জানতে পেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে পাট বাদে অন্যান্য খাতে। পাট খাতে দেওয়া হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোকে একই অর্থবছরে এ টাকা ছাড়ও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মাহবুব আহমেদ, সাবেক অর্থসচিব
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৭ জুলাই প্রথম কিস্তি, ৯ নভেম্বর দ্বিতীয় কিস্তি, এ বছরের ১৬ মার্চ তৃতীয় কিস্তি ও ৬ মে চতুর্থ কিস্তির টাকা দেওয়া হয়। পাট খাতে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তিতে ১২৫ কোটি করে, তৃতীয় কিস্তিতে ২৫০ কোটি ও চতুর্থ কিস্তিতে ৩০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। পাট বাদে অন্যান্য খাতে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তিতে ১ হাজার ৭০৬ কোটি ২৫ লাখ করে, তৃতীয় কিস্তিতে ১ হাজার ৪৩৩ কোটি ১০ লাখ ও শেষ কিস্তিতে ১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়।
প্রতিবছর নগদ সহায়তা বাবদ মোটা অঙ্ক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় হলেও যথাযথ জায়গায় তা ব্যয় হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে মাঝে মাঝেই তা ধরা পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন নিয়মকানুন একটু কড়া। তারপরও বলব, যেহেতু এককভাবে কেউ জালিয়াতি করতে পারে না, সেহেতু প্রথমে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও পরে বাংলাদেশ ব্যাংককে কাগজপত্র যাচাইয়ে আরও মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
এদিকে ব্যাংকগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেছে, বিদায়ী অর্থবছরে নগদ সহায়তার মধ্যে অপরিশোধিত দাবির পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাট খাতে ১০০ কোটি টাকা ও অন্যান্য খাতে ৮০০ কোটি টাকা অপরিশোধিত রয়েছে। চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ তথ্যও জানিয়েছে অর্থ বিভাগকে।
কোন বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম কিস্তির নগদ সহায়তা দেওয়ার জন্য ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা চাওয়া হলো—এ সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, ‘কয়েক মাস ধরে ব্যাংকগুলোর আবেদন করা অর্থের পরিমাণের প্রবণতা পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে যে চলতি অর্থবছরের প্রথম কিস্তিতে পাট খাতের জন্য ৩০০ কোটি এবং পাট বাদে অন্যান্য খাতের জন্য ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা লাগবে।’
নগদ সহায়তা পাওয়ার জন্য সাধারণত রপ্তানির ছয় মাসের মধ্যে সব কাগজপত্রসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকে আবেদন করতে হয় রপ্তানিকারকদের। বিশেষ ক্ষেত্রে আরও দেড় মাস সময় বাড়াতে পারে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক কাগজপত্র যাচাই করে সুপারিশ পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংক আবার তা যাচাই করে সন্তুষ্ট হওয়ার পর রপ্তানিকারকদের অনুকূলে অর্থ ছাড় করে।
এরপরও নগদ সহায়তা নিয়ে জালিয়াতি হয় মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে রপ্তানিকারকেরা জালিয়াতি করে থাকেন। ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে এভাবে অর্থ আত্মসাৎ অব্যাহত থাকায় দেশের প্রকৃত উদ্যোক্তাদের অনেকে রপ্তানি করেও যথাসময়ে সহায়তা পান না।
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দাবি অনিষ্পন্ন এখনো। অথচ ঈদের আগে শ্রমিকদের মজুরি-বোনাস দিতে টাকা দরকার। অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত প্রথম কিস্তির টাকাটা ছাড় করলে ভালো হয়।’
ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা নিয়ে জালিয়াতি হয় কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘পারতপক্ষে পোশাক খাতে তা হয় না। তবু সার্বিক জালিয়াতি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের কঠোর নজরদারি দরকার।’
Leave a Reply